📝 শুভদীপ রায় চৌধুরী, Todays Story: ১৭৫৭ সাল, নবাব সিরাজদৌল্লা পরাজিত হন পলাশির প্রান্তরে ব্রিটিশ কোম্পানির কাছে। দীর্ঘদিনের নবাবী শাসনের অবসানের পর শুরু হয় দুশো বছরের সাম্রাজ্যবাদী শাসন। রবার্ট ক্লাইভের সেই জয়কে সম্মান জানাতে উত্তর কলকাতার শোভাবাজার রাজবাড়িতে দুর্গাপুজো শুরু করেন মহারাজা নবকৃষ্ণ দেব। কোন পুজোকে কেন্দ্র করে এত বড় উৎসবের আয়োজন সর্বপ্রথম রাজবাড়িতেই শুরু হয় নবকৃষ্ণের উদ্যোগে। ক্লাইভ থেকে হেস্টিংস, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে বিদ্যাসাগর, কে আসেন নি শোভাবাজার রাজবাড়ির দুর্গাপুজোয় তা খুঁজে পাওয়া যায়না।
দীর্ঘদিন নবকৃষ্ণের কোনও সন্তান না হওয়ায় বংশরক্ষার জন্য ১৭৬৮ সালে দাদার ছেলে গোপীমোহনকে দত্তক নেন। এর ১৩ বছর বাদে মহারাজার পঞ্চম রানি জন্ম দেন এক পুত্রসন্তান, নাম রাজকৃষ্ণ। পণ্ডিতেরা গণনা করে বলেন, রাজকুমারের পক্ষে উত্তরের বাড়ি মঙ্গলজনক নয়। সঙ্গে সঙ্গে নবকৃষ্ণ গড়ে তোলেন ঠাকুরদালান সমেত দক্ষিণের ছয় মহলা বাড়ি। ১৭৫৭ সালে নবকৃষ্ণ প্রথমে উত্তরদিকের বাড়িতে দুর্গাপুজো শুরু করেছিলেন। কিন্তু পরে দক্ষিণদিকের বাড়িতেও ১৭৯০ সালে দুর্গাপুজোর সূচনা করেন। বর্তমানে উত্তরের রাজবাড়িটি গোপীমোহনের ছেলে রাধাকান্ত দেবের এবং দক্ষিণ দিকেরটি রাজকৃষ্ণ দেবের পুজো বলেই চিহ্নিত।
রাধাকান্ত দেবের বাড়িতে রথের দিন এবং রাজকৃষ্ণ দেবের বাড়িতে উল্টোরথের দিন কাঠামো পুজো সম্পন্ন হয়। তারপরই ঠাকুরদালানেই প্রতিমা নির্মাণের কাজ শুরু হয়। একচালার ডাকের সাজের সাবেকি মূর্তিই নির্মিত হয় শোভাবাজার রাজবাড়িতে। রাধাকান্ত দেবের বাড়ির সিংহটি সাদা রঙের ঘোড়ামুখো সিংহ, মহিষাসুর সবুজ বর্ণের। আর রাজকৃষ্ণদেবের বাড়ির প্রতিমার সিংহটি ব্রিটিশ সিংহ এবং মহিষাসুরের রং সবুজ।যেহেতু সেই সময় মেয়েদের বাইরে আসার তেমন নিয়ম ছিল না, আর দেবী দুর্গাকে বাড়ির মেয়ে হিসাবে কল্পনা করা হত তাই রাজকৃষ্ণ দেবের প্রতিমার সামনে সার দিয়ে বেশ কয়েকটা জরির সুতো ঝোলানো থাকে। যাতে বাইরের মানুষ মাকে সরাসরি দেখতে না পায়।
কৃষ্ণানবমীতে বোধন শুরু হয় শোভাবাজার রাজবাড়িতে। বোধনের দিন থেকেই প্রত্যেকটি দিন ১৫ জন ব্রাহ্মণ শ্রীশ্রীচণ্ডী, রামায়ণ এবং অন্যান্য বহু শাস্ত্র পাঠ করেন। সপ্তমীর সকালে রুপোর ছাতা মাথায় নিয়ে নবপত্রিকাকে বাগবাজারের ঘাটে স্নান করাতে নিয়ে যাওয়া হয়। এই বাড়িতে দেবীকে অন্নভোগ দেওয়া হয় না, তাই আতপচাল, নানান ফল, মিষ্টি দই, ভোগ হিসেবে নিবেদন করা হয়। সেকালে বাড়িতে ভিয়েন বসত, তৈরি হত নানারকমের মিষ্টি। এখনও ভিয়েন বসে, তৈরি হয় জিবেগজা, লবঙ্গলতিকা, মালপুয়া ইত্যাদি। আজও সন্ধিপুজোর সময় বন্দুক ফাটানো হয়। দশমীর সকালে দর্পণ বিসর্জনের পর বিকালে কাঁধে করে প্রতিমা বিসর্জন হয়। অতীতে নীলকণ্ঠ পাখি উড়িয়ে শ্বশুড়বাড়িতে খবর দেওয়ার এক রীতি ছিল, তবে বর্তমানে মাটির তৈরি নীলকণ্ঠ পাখিই ওড়ানো হয়। আবারও একবছরের জন্য বাপের বাড়ি ছেড়ে উমা শ্বশুরালয় যাত্রা করবেন, তাই তার আগে কনকাঞ্জলি দেওয়া হয় রুপোর থালায়। তারপর কাঁধে করে প্রতিমা গঙ্গার ঘাটে নিয়ে গিয়ে মাঝ গঙ্গায় বিসর্জন হয় শোভাবাজার রাজবাড়ির দুর্গা প্রতিমা।