📝 নিজস্ব সংবাদদাতা, Todays Story: মঙ্গলবার সন্ধ্যায় যে হলং বাংলো পুড়ে ছাই হয়ে গেল সেটির সঙ্গে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত জ্যোতি বসুর অনেক আনন্দঘন মুহূর্ত জড়িয়ে ছিল। মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে সুযোগ পেলেই ওই বাংলায় গিয়ে উঠতেন তিনি। এছাড়া পুজোর ছুটিতেও বেশ কয়েকবার জলদাপাড়া অভয়ারণ্যের ভিতরে গভীর জঙ্গলে ঘেরা ওই বাংলোই হত তাঁর অস্থায়ী ঠিকানা। বেশ কয়েকবার তিন নাতনি সহ ছেলে চন্দনের পরিবারকে নিয়ে ওই বাংলোয় কাটিয়েছিলেন জ্যোতি বসু। তা নিয়ে তখনকার দিনে বিতর্ক হত বিস্তর। সাধারণ মানুষ টিপ্পনি করতেন। সংবাদমাধ্যমের একাংশেও সমালোচনা হত।
রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যে বাংলোয় গিয়ে থাকেন, সেখানে অনেকেই যেতে চান। তা ছাড়া সরকারি ভাবে যখন তা বুকিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে, তখন কোনও অসুবিধা নেই। জলদাপাড়া অভয়রাণ্যও বাঙালির পর্যটন মানচিত্রে চিরবসবুজ হয়ে আছে। তখনও ওই বাংলোয় থাকার হিড়িক ছিল। জ্যোতিবাবু যাবেন বলে শেষ মুহূর্তে অনেকেরই হলং বাংলোর বুকিং বাতিল হত। স্বভাবতই তারা ক্ষোভ উগড়ে দিতেন। জ্যোতিবাবু তা নিয়ে কোনও বাগবিতণ্ডায় জড়াননি। এসব ক্ষেত্রে নীরব থাকাই পছন্দ করতেন।মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন প্রায় সব বছরই পুজোর ছুটি বাইরে কাটাতেন জ্যোতি বাবু। এসব নিয়ে খুব বেশি আলাপ আলোচনায় যেতেন না। তবে এক দু’বার ঘনিষ্ঠ মহলে বলেছেন, সারা বছরের কোলাহল থেকে একটু মুক্তি পেতে হলে থেকে দূরে কোথাও যাওয়াই ভাল।
দেখা যেত অনেক বছরই তিনি উত্তরবঙ্গকে বেছে নিয়েছেন এবং থাকার জন্য প্রথম পছন্দ ছিল জলদাপাড়া অভয়ারণ্য। আসলে শুধু অভয়ারণ্যের সবুজই নয় হলং বাংলোটিও ছিল তাঁর অত্যন্ত প্রিয় জায়গা। চারপাশে ঘন সবুজে ঘেরা পরিবেশ এবং বাংলোর বারান্দায় বসে গাছগাছালির সৌন্দর্য উপভোগ করার পাশাপাশি বন্যপ্রাণী দেখার বাসনা ও মেটাতেন। বিশেষ করে হাতির পাল প্রায়ই বাংলোর পাশ দিয়ে হেঁটে যেত এছাড়াও অন্যান্য বন্যপ্রাণী তো ছিলই। আর একবার উত্তরবঙ্গের মন্ত্রী দীনেশ ডাকুয়াকে বলেছিলেন এবার হলং যাওয়ার পথে দেখলাম রাস্তার দু’পাশে অনেক গাছ কাটা হয়েছে। একটু খোঁজ নেবেন এগুলো কি বন দফতরের কেটেছে নাকি কাঠ পাচারকারীদের কারবার। এই দুই মন্ত্রীই ছিলেন উত্তরবঙ্গের মানুষ। বামফ্রন্টের জমানায় বন দফতরের দায়িত্ব উত্তরবঙ্গের নেতাদেরই মূলত দেওয়া হত। পরিমল মিত্র ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয় নেতা এবং সুদক্ষ মন্ত্রী। দীনেশ ডাকুয়াও তাই।
কোচবিহারের মানুষ দীনেশ বাবু একবার কথায় কথায় আক্ষেপ করেছিলেন, জ্যোতিবাবুর হলং বাংলায় থাকা নিয়ে এত কথা হয়। কিন্তু আমরা জানি উনি শুধু আরাম করতে যান না। ওঁর মধ্যে যে প্রকৃতি প্রেম আছে সেটা ওখানে গেলে আরও বেশি বোঝা যেত। সাংবাদিক অরুন্ধতী মুখোপাধ্যায় দীর্ঘ সময় সাংবাদিককতার সুবাদে জ্যোতিবাবুর সফরসঙ্গী হয়েছেন। তাঁর কথায়, “হলং বাংলো কেন ওঁর বিশেষ পছন্দ ছিল কখনও বোধহয় মুখ ফুটে বলেননি। তবে লৌহ কঠিন ব্যক্তিত্বের মানুষটি প্রকৃতির টান অনুভব করতেন, পশু পাখিদের প্রতি দরদী ছিলেন সেটা ওই বাংলোর প্রতি টান থেকেই বোঝা যেত। চারপাশে গাছ আর পশুপাখি ছাড়া কিছুই তো সেখানে ছিল না”।
জ্যোতিবাবুর ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দ পাঁচজনের কাছে বলে বেড়ানোর মানুষ ছিলেন না। তবে, উত্তরবঙ্গে, বিশেষ করে জলদাপাড়ার কাছাকাছি গেলে অফিসারদের ডেকে বলে দিতেন, দেখুন তো হলং বাংলো ফাঁকা আছে কিনা। ওখানে থাকার ব্যবস্থা করা গেলে ভাল হয়।
কিন্তু ওই বাংলো কেন তাঁর এত পছন্দ সে কথা কাউকে মুখ ফুটে বলেছেন বলে শোনা যায়নি। আর ব্যক্তিগত কথা লিপিবদ্ধ করা তো তাঁর পার্টিতে শৃঙ্খলা বিরুদ্ধ। ‘যতদূর মনে পড়ে’ বইটি তাঁর রাজনৈতিক আত্মকথন। সেখানে ব্যক্তি জ্যোতি বসুর কথা খুব সামান্য আছে। যে টুকু আছে সেটাও পার্টির প্রয়োজনের কথা ভেবেই লিপিবদ্ধ করেছেন। হলং বাংলোর প্রতি বিশেষ টান কেন ছিল তা অজানাই থেকে গিয়েছে। ঘনিষ্ঠরা অনুমান করেছেন প্রকৃতির কাছাকাছি কিছু সময় কাটাতেই বারে বারে সেখানে গিয়ে উঠতেন।