অভিনয়ের টানে কাঁথি থেকে শহরে, চাকরি ছেড়ে থিয়েটার, রইল পর্দার ‘মহিষাসুর’  সায়নদীপ নন্দের কঠিন বাস্তব

📝 নিজস্ব সংবাদদাতা, Todays Story: অভিনয় যখন নেশা সেটাকে পেশায় পরিণত করার জন্য কসরত করতে হয় অনেক। তা বলে, ছোট্ট একটা গ্রাম থেকে একাকী শহরে এসে তাল মেলানো, মোটেই সহজ কথা নয়। বর্ষীয়ান অভিনেতা অভিনেত্রীরা বলেন থিয়েটার নাকি অভিনয়ের ভীত। কিন্তু থিয়েটার করলে তো পকেট ভরে না। উল্টে নিজের পকেটের টাকা দিয়ে থিয়েটার করতে হয় বলে শোনা যায়। আর সেই থিয়েটারের টানে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার দুঃসাহসিকতা দেখানোর মানসিকতা কজনের আছে? যে চাকরি দুবেলা দুমুঠো খাবারের জোগান দেয়, যে চাকরি নিজের ভরণ পোষণের দায়িত্ব নিজেকে নিতে ভরসা জোগায় সেই চাকরি ছেড়ে টলিউডে! তাও আবার ফ্যামিলির সাপোর্ট ছাড়া! হ্যাঁ, অবিশ্বাস্য হলেও এটাই সত্যি। এমন কঠিন বাস্তবের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেকে দক্ষ অভিনেতা তৈরি করার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন সায়নদীপ নন্দ।

এ বছর মহালয়ায় একটি প্রোডাকশন হাউসের ইউটিউব চ্যানেলে মহিষাসুর রূপে আত্মপ্রকাশ তার। এখন তার অভিনয় প্রশংসিত হচ্ছে সামাজিক মাধ্যম থেকে বন্ধু বান্ধব পরিবার আত্মীয় স্বজনদের মধ্যেও। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার একটা ছোট্ট গ্রাম বাহিরি। সায়নদীপ এর জন্ম, বেড়ে ওঠা আর অভিনয় চর্চা শুরু কাঁথি থেকে। তবে অভিনয় তার রক্তে। সায়নদীপ এর মা একটা সময় থিয়েটার করতেন। বাবা, জেঠু, দাদা যাত্রা করতেন। সকলেই ছিলেন মঞ্চ শিল্পী। সেই মঞ্চ আর অভিনয়ের টান রয়েছে সায়নদীপ এর মধ্যে সেই ছোট থেকে। ৪ বছর বয়সে প্রথম মঞ্চে পা রাখা। তারপর মেজো জেঠুর হাত ধরে  কন্টাই শিশু মহলে ভর্তি হওয়া এবং বেশ কয়েকজন ভালো প্রশিক্ষক এবং নিজের ভালোবাসার দৌলতে একের পর এক নাটক করার সুযোগ পাওয়া।  পেটে ও পিঠে, চমচমকুমার, স্ট্যাচু এরকম অনেক নাটকে অভিনয় করেছেন সায়নদীপ। সেই ছোটো থেকেই অভিনয় আর মঞ্চের প্রতি অগাধ ভালোবাসা আর সাথে মঞ্চে দাঁড়িয়ে সামনে দর্শকের হাততালি পাওয়ার অদ্ভুত আনন্দ আজও তার অভিনয়ের খিদে বাড়িয়ে দেয়। তারপর স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে যখন কলেজে পা পড়ে তখনও পড়াশুনা করার পাশাপাশি প্রত্যেক বছর ” Youth Parliament” এ অংশগ্রহণ করে অভিনয় করার একটা সুযোগ পেয়েই যেতেন সায়নদীপ। পূর্ব এবং পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বেশ কিছু কলেজকে  হারিয়ে  ” Best Leader Of The Opposition” এর পুরস্কারও ছিনিয়ে নেন এই তরুণ তুর্কী। সবকিছু  ঠিকঠাকই চলছিলো কিন্তু হঠাৎ  সমস্যা শুরু হলো যখন কলেজের স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করার পর সায়নদীপ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন ” আমি অভিনেতাই হবো, থিয়েটার করবো এবং কলকাতায় চলে আসবো “।  এরপর ২০১৫ সালে,পরিবারের মায়া ত্যাগ করে, নিজেই নিজের সব দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়ে একদম অচেনা, অজানা একটা শহরে একাই চলে আসেন। সাথে নিয়ে আসেন একটা চাকরি, যেটা তাকে থাকা – খাওয়ার রসদ সরবরাহ করবে। কিন্তু কোথায় কার সাথে যোগাযোগ করতে হবে , কী করলে কী হবে এটা ভাবতে ভাবতেই একটা বছর কেটে গেলো। এরপর ২০১৬ সালে  AKTO- এর সাথে আবার থিয়েটারের পথ চলা শুরু হলো সায়নদীপের। প্রকৃত থিয়েটার কেমন, কীভাবে অভিনয় হয় তার অনেকটাই শেখা সেখান থেকে। প্রথম কলকাতায় এসে মঞ্চে দাঁড়ানোর সুযোগ পাওয়া সেই সূত্রেই । দুটো বছর এভাবেই চলার পর হঠাৎ একদিন সেই দিন এলো যেখানে ” থিয়েটার নাকি চাকরি??” এই কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি হতে হয় সায়নদীপকে। প্রশ্নের উত্তর বার করতে গিয়ে তাকে থিয়েটার থেকে বিরতি নিতে হলো। তারপর যখন ভাবলেন আবার শুরু করবেন তখন কোভিড এসে বললো ‘কোরোনা’ । অগত্যা নিরুপায় হয়ে অস্থির মন নিয়ে চুপ করে থাকলেও বেশ কয়েকমাস যাওয়ার পর যখন কোরোনা একটু স্থীতিশীল তখন আবার “নাম নেই” দলের সাথে নিজেকে জুড়ে দেওয়ার সুযোগ হল। সারারাত জেগে চাকরি আর শনিবার আর রবিবার থিয়েটার করা শুরু হলো সেই থেকে। আপাতত শেষ চার বছর ধরে Shahoj – সহজ বলে একটি দলের সাথে যুক্ত সায়নদীপ নন্দ। ‘ হিসু ‘,”Party On The Battlefield “, “ভিটামিন M” এইসব নাটকে নানা চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। ব্যক্তিগত জীবনে হাজার বাধা আসা সত্ত্বেও থিয়েটার বা অভিনয় ছেড়ে দেওয়ার কথা মাথা তেও আসে না তার, মা সবসময় ভরসা আর সাহস জুগিয়েছে তাকে।  দীর্ঘ নয় বছর চাকরি করার পর এখন চাকরি ছেড়ে সম্পূর্ণভাবে অভিনয়ে মনোনিবেশ এবং এটাই করতে চান সায়নদীপ। নিজেকে এখনও অনেকটাই তৈরি করা বাকি আছে বলেই মনে করেন তিনি। এর আগে ক্যামেরার সামনে কাজ করা হয়নি তেমনভাবে। কেউ সুযোগটাই দেয়নি, আদৌ সে পারে কিনা সেই দক্ষতা যাচাই করারও সুযোগ হয়নি। চাকরি ছেড়ে আজকে শুধুই থিয়েটারই ধ্যান জ্ঞান।  নিজের দক্ষতা সম্পর্কে আত্মবিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে চলেছেন সায়নদীপ । আর্থিক সমস্যা আর বেঁচে থাকার লড়াই এর সাথে সাথে থিয়েটার চালিয়ে গেছেন, ছাড়েননি আর ছাড়বেন  না বলেও দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।এভাবেই একদিন হঠাৎ করে ফেসবুকে একটা পোস্ট চোখে পড়ে ভয়েস ওভারের কাজ এর জন্য পুরুষ কণ্ঠ চাই। সুযোগ পেয়েই সুযোগের সদ্ব্যবহার করা। Telly Durga Production এর সাথে যোগাযোগ করে শেষ বছর   রামচন্দ্রের কণ্ঠ দিয়েছিলেন সায়নদীপ এবং এই বছর মহিষাসুরের ভূমিকায় অভিনয় করার সুযোগ আসে। এভাবেই ভালো কাজ করে যেতে চান সায়নদীপ। দক্ষিণী সিনেমায় কাজ করার ইচ্ছা থাকলেও টলিউড যে তার আগে তা বার বার বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি। সায়নদীপ নন্দ, মফঃস্বলের ছেলে মেয়েদের জন্য একটা উদাহরণ হয়ে রইল।