জমিদারি লাভের পর নিজের বাড়িতেই কালীপুজো শুরু করেন রামদুলাল রায় চৌধুরী

📝শুভদীপ রায় চৌধুরী , Todays Story: কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোর পর জোরকদমে তোড়জোড় শুরু হয়ে গিয়েছে কালীপুজোর। দীপাবলির আলোয় সমস্ত অন্ধকার কেটে যাক, এই প্রার্থনা। কালীপুজোর অমাবস্যায় বাংলার বহু বনেদি বাড়িতে ধুমধাম করে উৎসব হয়। পশ্চিম  মেদিনীপুরের খেপুত গ্রামে সাবর্ণদের বহুদিনের কালীপুজো, একই ধারাবাহিকতা বজায় রয়েছে আজও।     
প্রসঙ্গত, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার চেতুয়া অঞ্চলের জমিদারি লাভ করে সাবর্ণ গোত্রীয় রামদুলাল রায় চৌধুরী ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে। তারপর, রামদুলাল বড়িশা থেকে চলে যান রূপনারায়ণ নদের পশ্চিম তীরে খেপুতের উত্তরবাড় গ্রামে। বর্ধমান রাজপরিবারের রাজা তেজচাঁদের খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন রামদুলাল রায় চৌধুরী। সে সময় মেদিনীপুরের চেতুয়া ও বরদা পরগনা রাজা তেজচাঁদের জমিদারির অন্তর্ভুক্ত ছিল। ওই দুই পরগনার জন্য ছোটো জমিদারের খোঁজ করছিলেন তেজচাঁদ। তখনই তেজচাঁদের মনে পড়ে রামদুলালের কথা। তাঁকেই ওই অঞ্চলের জমিদারি দেন বর্ধমান রাজ তেজচাঁদ।       
উল্লেখ্য, রামদুলাল রায় চৌধুরী চেতুয়ার জমিদারি পেয়ে খেপুত উত্তরবাড় মৌজায় নিজ বাসস্থান তৈরি করেন। এছাড়া, মাটির ঠাকুরঘর নির্মাণ করেন। সেই সঙ্গে রঘুনাথজিউকেও তাঁরা খেপুতের বাড়িতে নিয়ে যান। উত্তরবাড়ের প্রাচীন বিগ্রহ শ্রীশ্রীমা খেপতেশ্বরী অষ্টভুজা মহিষমর্দিনী, সেটি দক্ষিণমুখী আটচালা মন্দির। মন্দিরের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ যথাক্রমে ২৪ ফুট ১০ইঞ্চি এবং ২৩ ফুট ৬ইঞ্চি।
১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে কার্তিক মাসের অমাবস্যায় রামদুলাল তাঁর খেপুতের বসত বাড়িতে কালীপুজো শুরু করেন। বিজয়াদশমীর দিন রামদুলাল আমিষ ভোগ দিয়ে দেবীর তৃণমূর্তির পায়ে মাটি লেপন করেন। আজও ওইদিন বিশেষ নিয়মে পুকুর থেকে মাটি তোলা হয়। পরের দিন থেকেই শুরু হয় কালী প্রতিমা তৈরির কাজ। নিয়ম মেনে পারিবারিক আটচালায় তৈরি হয় দেবী প্রতিমা। অর্থাৎ বড়িশার দুর্গাপুজো শেষ হতেই খেপুতবাড়ির কালীপুজো শুরু হয়। সাবর্ণদের এই খেপুত গ্রামের কালীপুজোর সঙ্গে যে সব সূত্রধর, কর্মকার, কুম্ভকার, মালাকার ও গো-পালক পরিবার জড়িত ছিলেন, তাঁরা বংশানুক্রমিক ভাবে আজও এই পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন।
বলাবাহুল্য, কালীঘাটের দেবী কালী হলেন সাবর্ণদের কুলদেবী। তাঁর অনুকরণেই খেপুতের কালিকা দেবীর নাকে রয়েছে রসকলি, বৈষ্ণবী তিলক। দেবী দীঘলনয়না, গলায় নরমুণ্ডমালা। তিনি চতুর্হস্তা, স্বয়ং ভদ্রকালীরূপ। ভীষণা মূর্তির মধ্যেই তাঁর স্নেহময়ী মাতৃরূপ ফুটে ওঠে। দেবীর বাম দিকে শৃগাল ও ডাকিনী আর ডানদিকে যোগিনী।
কালীপুজোর দিন ঘট তোলার আগে প্রথমে মাটির হাঁড়িতে জল ভর্তি করা হয়। সেই হাঁড়ি রাখা হয় আটচালাতেই। জলের হাঁড়িতে প্রদীপ ভাসিয়ে দেওয়া হয়। প্রদীপে থাকে ছোটো ছোটো ছিদ্র। ওই ছিদ্র দিয়ে জল-ঢুকে প্রদীপ পূর্ণ হলেই তা ডুবে যায়। আর প্রদীপ ডোবা মাত্রই পরিবারের এক পুকুরেই ঘট ডুবিয়ে পুজো শুরু হয়।
এছাড়া, কালীর আমিষ ভোগে সব রকম সবজি দেওয়া হয়। অন্নভোগ, খিচুড়িভোগ, ডাল, ভাজা, পায়েস, নানা রকমের তরকারি ইত্যাদি নিবেদন করা হয়। মহাকালের জন্য আতপচালের নিরামিষ ভোগও হয়। সাবর্ণ পরিবারে কালীপুজোয় বলিদানের সময়ে ঢাক-ঢোল-কাঁসরের আওয়াজে গোটা পাড়া মুখরিত হয়। কালীপুজো উপলক্ষ্যে বাড়ির মেয়েরা বাজি প্রদর্শনীতে মেতে ওঠেন ও বিশেষ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও হয়।
এর পাশাপাশি, দীপান্বিতা কালীপুজোর দিন কুলো বাজিয়ে চালগুঁড়ি আর গোবরের তৈরি অলক্ষ্মী মূর্তি বিদায় করে লক্ষ্মীপুজোর রীতিও প্রচলন করেছিলেন সাবর্ণদের কুলতিলক রামদুলাল। তবে এই লক্ষ্মীপুজো দেবালয়ে না করে বাড়ির গৃহকোণে অনুষ্ঠিত হয়।
এই ভাবে দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য ও পরম্পরাকে অক্ষুণ্ণ রেখেই পশ্চিম মেদিনীপুরের খেপুত গ্রামে ডাকের সাজে সজ্জিত করালবদনা কালীর পুজো আজও সাবর্ণরা করে আসছেন। খেপুত-সহ গোটা মেদিনীপুর অঞ্চলের মানুষের কাছে এই পুজো খুবই জনপ্রিয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *