📝শুভদীপ রায় চৌধুরী, Todays Story: সামনেই দীপাবলী, আলোর উৎসব। সমস্ত মানুষের জীবনের অন্ধকার কাটিয়ে মা আলোর বাতাবরণ তৈরি করুন, এমনটাই প্রার্থনা। কলকাতা তথা বঙ্গের প্রাচীন কালীমন্দিরগুলিতে কালীপুজো অনুষ্ঠিত হবে। কালীক্ষেত্র কলকাতায় মা করুণাময়ী কালীমন্দির বহু প্রাচীন। কথিত আছে, স্বয়ং রানী রাসমনি এই করুণাময়ীর প্রাচীন নবরত্ন মন্দিরের আদলেই দক্ষিণেশ্বরের মন্দির তৈরি করেছিলেন।
প্রসঙ্গত, দক্ষিণ কলকাতার টালিগঞ্জের মজে যাওয়া প্রাচীন আদিগঙ্গা, তারই উপকূলে এক প্রাচীন জনপদ, সেকালে পুঁটিয়ারী নাম ধারণ করে স্থানীয়দের কাছে আত্মপ্রকাশ করে। আর এই অঞ্চলেই মা করুণাময়ীকে প্রতিষ্ঠা করেন সাবর্ণ চৌধুরীদের বংশধর নন্দদুলাল রায় চৌধুরী। তবে চৌধুরীদের বঙ্গে বহু কালীমন্দির রয়েছে। কুলদেবী কালীঘাটের কালীমন্দির নির্মাণ করা ছাড়াও সাবর্ণ রায় চৌধুরীরা বড়িশা, সরশুনা, হালিশহর, উত্তরপাড়া, নিমতা, খেপুত ও বেহালার নানাস্থানে অসংখ্য স্মরণীয় কীর্তি স্থাপন করে গিয়েছেন। দ্বাদশ শিবমন্দির, রাধাকান্ত মন্দির, চণ্ডীমন্দির, অন্নপূর্ণা মন্দির, জগন্নাথ মন্দির, দুর্গামণ্ডপ ইত্যাদি।
উল্লেখ্য, এই বংশের কুলতিলক কেশবরাম রায় চৌধুরীর সময়েই লক্ষ্মীকান্তের বিশাল জায়গীর উত্তরসুরিদের মধ্যে ভাগ হয়। আর অল্প বয়সেই কেশবরাম সমগ্র বাংলাদেশে নিজেকে এক সুপ্রশাসক ভূস্বামীরূপে প্রতিষ্ঠিত করেন। বাংলার তৎকালীন নবাব তাঁর ভূমি-সংস্কার ও অন্যান্য কাজকর্মে খুশী হয়ে ১৬৯৯ সালে এক বিশেষ সনদে তাঁকে বহু অতিরিক্ত জায়গীর সহ স্বতন্ত্র ‘রায় চৌধুরী’ খেতাবও প্রদান করেন। এর পাশাপাশি, নিজের দক্ষতা ও বিচক্ষণতার কারণে অচিরেই সমগ্র দক্ষিণবঙ্গের সমাজপতি হয়ে ওঠেন কেশবরাম।
বলাবাহুল্য, এই কেশবরামের দ্বিতীয়পুত্র কৃষ্ণদেব রায় চৌধুরীর একমাত্র পুত্র নন্দদুলালের পরপর তিনটি পুত্রসন্তান হয়, যথাক্রমে- রাঘবেন্দ্র, রামচরণ ও জগন্নাথ। নন্দদুলালের কাকা শিবদেব ওরফে সন্তোষ রায় চৌধুরী বহু অর্থ ব্যয় করে কালীঘাটের মন্দির তৈরি করেন ও শিবদেবের উত্তরসুরি রাজীবলোচন ১৮০৯ সালে সেই মন্দিরের নির্মান কার্য শেষ করেন।
নন্দদুলালের তিন পুত্রসন্তানের পর তাঁর একটি কন্যাসন্তানের ইচ্ছা ছিল। সেই ইচ্ছা মতন একটি কন্যাসন্তানের জন্ম হয়, নাম রাখা হয় করুণাময়ী। কিন্তু মাত্র সাত বছর বয়সে করুণাময়ীর অকালপ্রয়াণ ঘটে। কন্যার মৃত্যুতে নন্দদুলাল মর্মাহত হন। এই সময় একদিন রাত্রে স্বপ্নে দেখেন তাঁর মৃত কন্যা বলছে-“বাবা তুমি কেঁদো না, আমি তোমায় কোনদিনই ছেড়ে যেতে পারবো না।কাল ভোরে তুমি আদিগঙ্গার ঘাটে যেও, সেখানে একটি কষ্টিপাথর দেখতে পাবে বটগাছের তলায়। সেই পাথর দিয়েই তোমার ইষ্টমূর্তি গড়ে প্রতিষ্ঠা করো। আমি ওই মূর্তিতেই চিরদিন বিরাজ করবো।” পরের দিন ভোরবেলা নন্দদুলাল গঙ্গার ঘাটে ঠিক একটি কষ্টিপাথর পান। চোখের জলে সেই শিলা তুলে নিয়ে এলেন। শুভদিনে জনৈক অন্ধ ভাস্করকে দিয়ে নির্মাণ করান মায়ের অপূর্ব নয়নাভিরাম করুণাময়ী মূর্তি।
১৭৬০ সালে কার্তিক মাসের অমাবস্যায় প্রাণপ্রতিষ্ঠা হয় সেই মূর্তির। একইসঙ্গে নির্মিত হয় করুণাময়ীর নবরত্ন মন্দির। কালের বিধ্বংসী স্রোতে ও সংরক্ষণের অভাবে ১৪০ বছরের মধ্যেই করুণাময়ীর সেই নবরত্ন মন্দির ধ্বংস হয়। সেকালে প্রাচীন নবরত্ন মন্দির দেখে অভিভূত হন রাণী রাসমনি এবং করুণাময়ী মন্দিরের আদলেই দক্ষিণেশ্বরের নবরত্ন মন্দির নির্মান করান। পুরানো মন্দির ধ্বংস হলেও নন্দদুলালের সেই প্রতিষ্ঠিত করুণাময়ী এবং মহাকালের বিগ্রহ আজও বিরাজমান।
নন্দদুলালের দ্বিতীয় পুত্র দুর্গাদাসের পরিবারের তৃতীয় পুরুষ মনিমোহনের আমলেই নবরত্ন মন্দিরের জায়গায় একটি আটচালা মন্দির স্থাপিত হয়। পরে মনিমোহনের চতুর্থপুত্র অসিত রায় চৌধুরীর আমলে মন্দির সংরক্ষন শুরু হয়। ১৯৮৫ সালে নবকলেবরে মন্দির নির্মিত হয়।কালীপুজোর দিন বহুভক্তের সমাগম হয় এই মন্দিরে। তবে কালীপুজোর দিন কুমারীপুজো হয় এই মন্দিরে। রাতে করুণাময়ীকে রাজবেশে সাজানো হয় এবং মায়ের জন্য সমস্ত রকমের ভোগের পদ থাকে। ১১ রকমের মাছ, ৭রকম ভাজা, ৭রকমের তরকারি, সাদাভাত, পোলাও, লুচি, ছোলারডাল, দই, মিষ্টি, পায়েস ইত্যাদি ভোগ নিবেদন করা হয়।