দুর্গাপুজোর সময় ধ্রুপদী সঙ্গীতের আসর বসত পাথুরিয়াঘাটার ‘হরকুটির’এ

📝শুভদীপ রায় চৌধুরী , Todays Story: আর কয়েকদিনের অপেক্ষা, তারপরই গোটা শহর জুড়ে শুরু হবে উৎসবের মেজাজ। আট থেকে আশি সকলেই মেতে উঠবেন শারদোৎসবের আনন্দে। বারোয়ারি পুজোর পাশাপাশি বনেদি বাড়ির ঠাকুরদালানও সেজে উঠবে উমা আসার আনন্দে। ইতোমধ্যেই বনেদি কলকাতার ঠাকুরদালানে প্রতিমা তৈরির তোড়জোড় শুরু হয়ে গিয়েছে। চলতি বছর অক্টোবরের শুরুতেই আলোয় আলোয় সেজে উঠবে তিলোত্তমার অলিগলি। প্রতিটি বাঙালিই সারাবছর ধরে উৎসবের অপেক্ষাতেই থাকেন তাঁরা। বলাবাহুল্য, প্রতিমা শিল্পী থেকে শুরু করে পুরোহিত, বিদেশি পর্যটক থেকে সাধারণ আমজনতা- দুর্গাপুজোকে ঘিরে উন্মাদনা সকলের। বনেদি কলকাতার বাড়িগুলির অন্যতম পাথুরিয়াঘাটা স্ট্রিটের রায় বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার। সেকালে এই বাড়িতেই বসত ধ্রপদী সঙ্গীতের আসর। দুর্গাপুজোও তার ব্যতিক্রম ছিল না। বনেদি বাড়ির বৈঠকখানায় পাতা হত সাদা চাদর, অতিথিরা সেখানেই বসতেন। পাশে রাখা থাকত আতরদানি এবং তাতে থাকত দামী আতর। বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পীরা থাকতেন এ বাড়ির অনুষ্ঠানে, পরবর্তীকালে বাড়ির সদস্যরাই অংশগ্রহণ করেন।

 উল্লেখ্য, প্রায় তিনশো বছরেরও বেশি সময় ধরে এই বাড়িতে দুর্গাপুজো হয়ে আসছে। প্রাচীন রীতিনীতিকে মেনে আজও মহোৎসব পালন করে আসছেন বর্তমান প্রজন্মের সদস্যরা। এই বংশের আদি পুরুষ কেশব চক্রবর্তীর বংশধর রাধাকান্ত চট্টোপাধ্যায় পাথুরিয়াঘাটায় একটি কুটির নির্মাণ করে বসবাস শুরু করেন। সে সময় বংশে নুনের ব্যবসা এতটাই জনপ্রিয় হয় যে, রাধাকান্ত সেই ব্যবসার মুনাফা দিয়েই বাড়িটি নির্মাণ করেন, যার বর্তমান নাম 'হরকুটির'। কথা হল পরিবারের সদস্য অর্চিষ্মান রায় বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তিনি জানান, বংশের সুসন্তান রাধাকান্ত চট্টোপাধ্যায়ই বাড়িতে প্রথম দুর্গাপুজো শুরু করেন। সেকালে রাধাকান্তের প্রায় আড়াইশোটি নৌকা ছিল, যা দিয়ে নুনের ব্যবসা চালাতেন তিনি। বলাবাহুল্য, তাঁর কোন পুত্র সন্তান না থাকায় তাঁর কন্যার সঙ্গে বিবাহ হয় ঈশানচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়ের। 

উত্তর কলকাতার 'হরকুটির' এ প্রতিষ্ঠিত রয়েছেন সিদ্ধেশ্বর মহাদেব এবং শ্রীধর জিউ। তাঁদেরও নিত্য অন্নভোগ সেবা হয়। ঈশানচন্দ্রের পুত্র গঙ্গানারায়ণ বিদ্যায় ও মৃদঙ্গে পারদর্শী ছিলেন। গঙ্গানারায়ণের পুত্র হরপ্রসাদ বন্দোপাধ্যায় বাংলা, সংস্কৃত, ফার্সি, ইংরাজি, ফরাসি, লাতিন ইত্যাদি ভাষায় দক্ষ ছিলেন। এছাড়া সঙ্গীতেও বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। অবতারপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণের সংস্পর্শেও আসেন হরপ্রসাদ। উল্লেখ্য, গঙ্গানারায়ণের কাছে ধ্রুপদ ও সরস্বতী বাইয়ের কাছে রাগসঙ্গীতের তালিম নেন হরপ্রসাদ। এছাড়া কোচবিহার রাজদরবারের শিল্পী কৃষ্ণধন বন্দোপাধ্যায়ের কাছেও গানের তালিম নেন তিনি। এর পাশাপাশি, বীণাবাদনে সবচেয়ে বেশি পারদর্শী ছিলেন তিনি। এই পরিবারের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে যদুভট্টের স্মৃতি। একদা এই বাড়িতে ভিয়ানের ব্রাহ্মণ হয়ে এসেছিলেন। পরে সঙ্গীতে তাঁর বিরল প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে উপযুক্ত সম্মান দেয় এই পরিবার। এছাড়া এই বাড়িতে আসেন শ্রীরামকৃষ্ণ, মোহনানন্দ ব্রহ্মচারী প্রমুখ।

  এই বনেদি বাড়িতে কাঠামো পুজো হয় জন্মাষ্টমীর পরের দিন এবং দেবীর বোধন হয় প্রতিপদের দিন। রায় বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়ির দুর্গাপুজো হয় কালিকাপুরাণ মতে। সাবেকি একচালির প্রতিমায় লক্ষী-সরস্বতীর কোনও বাহন থাকে না। পুজোর ভোগে থাকে খিচুড়ি, সাদাভাত, পাঁচভাজা, বিভিন্ন রকম তরকারি, পায়েস ও চাটনি। রাতে লুচি ও ভাজা দেওয়া হয়। দশমীতে হয় পান্তা-ভাত। দশমীতে মাছ খেয়ে সধবা মহিলারা দেবীকে বরণ করেন। পরিবারের গৃহকর্ত্রী বরণের পরে আর দেবীর মুখ কেউ দেখেন না। তিনি একটি ঘরে দেবীর উল্টোদিকে একটি আসনে বসে একটি পাত্রে দইয়ের মধ্যে হাত ডুবিয়ে বসে থাকেন, যতক্ষণ না পর্যন্ত বিসর্জন সুসম্পন্ন হয়। পরিবারে আজও কনকাঞ্জলি প্রথা রয়েছে। সূত্রের খবর, এ বাড়ির পুজোয় প্রতিমা শিল্পীরা বংশ পরম্পরায় আসেন শান্তিপুর থেকে। ঠিক তেমনই ডাকের সাজের শিল্পী ভূতনাথ মালাকার আসেন বর্ধমানের পাটুলি থেকে। আর  ঢাকিরাও বংশপরম্পরায় আসেন জয়রামবাটি থেকে।
error: Content is protected !!