📝 নিজস্ব সংবাদদাতা, Todays Story: ১৯৮০-র ২৪ জুলাইয়ের রাত ৯.৩৫ মিনিট। ঝড়ের গতিতে দুঃসংবাদ ছড়িয়ে পড়েছে শহরে। ২৫ জুলাই সকাল থেকে আকাশভাঙা বৃষ্টি। সারা শহর প্রথমে ভেঙে পড়েছিল দক্ষিণ কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালে। তার পর তাঁর বাড়ি হয়ে স্টুডিয়োপাড়ায়। শেষে কেওড়াতলা শ্মশান। বাঙালি বাড়িতে যেন অলিখিত অরন্ধন। উত্তমকুমার প্রয়াত। পরনে ধাক্কাপাড় ধুতি, গরদের পাঞ্জাবি। কপালে চন্দনের কলকা। ফুলে, ধূপে, মালায় ঢাকা শরীর। বাঙালির ‘ম্যাটিনি আইডল’ চিরতরে চলে যাওয়ার সময়েও যেন মহানায়কোচিত। তাঁর জন্য যে এত চোখের জল জমা ছিল, যাওয়ার আগে বুঝতে পেরেছিলেন তিনি?
অভিনেতা ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায় সংবাদমাধ্যমের এই প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। অভিনেতা বাবা মন্টু বন্দ্যোপাধ্যায়ের দৌলতে তিনি উত্তমকুমারকে চেনেন হাফ প্যান্টের বয়স থেকে। এক বার উত্তমকুমারের জিম্মায় ছেলেকে রেখে শট দিতে গিয়েছেন মন্টুবাবু। ছোট্ট ছেলেটি বুঝতেই পারেনি, কার কাছে রয়েছে সে! বাড়ির জ্যাঠা-কাকা যে ভাবে খোঁজখবর নেন, মহানায়ক ঠিক সেই ব্যবহারটাই করেছিলেন। সে দিন অজান্তেই ভাস্কর ভালবেসে ফেলেছিলেন উত্তমকুমারকে।
শেষ দেখা ১৯৮০-র জানুয়ারিতে। সময়টা একেবারেই ভাল যাচ্ছিল না উত্তমকুমারের। ভাস্কর বলছেন, ‘‘সেই সময় ‘ফ্লপমাস্টার’ তকমা ফের তাঁর কপালে। উত্তমজেঠুর সারা ক্ষণ মনখারাপ আর ভয়। তাঁর সময় ফুরিয়ে আসছে, তাঁর আকর্ষণ তলানিতে— এই দুশ্চিন্তায় নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। জনে জনে এ-ও জিজ্ঞেস করছেন, তাঁকে আগামীতে কেউ কি আর মনে রাখবে? কাঁটা হয়ে থাকতেন, তিনি মারা যাবেন, উত্তমকুমারকেও লোকে ভুলে যাবে!’’
ভাস্করের আরও মনে হয়েছে, উত্তমকুমারকে হয়তো বুঝতে পারেননি তাঁর কাছের মানুষও। যেমন, গৌরী দেবী। তিনি বরাবর অরুণকুমার চট্টোপাধ্যায়কে ভালবেসেছিলেন। তাই উত্তমকুমারের খ্যাতি, প্রতিপত্তি দেখতে দেখতে একটা সময়ের পরে হাঁপিয়ে উঠেছিলেন। তাঁকে ঘিরে থাকা অনুরাগিণীর ঢল দেখতে দেখতে তিনি হয়তো বেশি করে অভিনেতা স্বামীকে বাঁধতে চেয়েছিলেন। সেই পরিস্থিতি থেকে বাঁচতেই হয়তো উত্তমকুমার একটা সময়ের পর দূরত্ব বাড়ান।
যদিও তৎকালীন একাধিক পত্রপত্রিকায় প্রকাশ, সমস্যার সূত্রপাত নাকি আরও আগে। উত্তমকুমারের প্রথম হৃদ্রোগে আক্রান্ত হওয়ার সময়। সেই সময়ের সংবাদপত্রে প্রকাশ, ‘ছোটি সি মুলাকাত’ ছবি করে দেনার দায়ে প্রায় মাথা বিক্রির অবস্থা তাঁর। দুশ্চিন্তায়, ভয়ে, অর্থাভাবে, নিদ্রাহীনতায় বিপর্যস্ত অভিনেতার আচমকা হৃদ্রোগ। সেটে অভিনয় করতে করতেই। হাসপাতালে না গিয়ে বাড়িতে সেই সময় চিকিৎসা করিয়েছেন তিনি। খ্যাতনামী চিকিৎসক তাঁকে দেখতে এসে চিনতে পারেননি! উল্টে জানতে চেয়েছিলেন, তিনি কোন পেশার সঙ্গে যুক্ত? কেন এত দুশ্চিন্তায় ভোগেন? অভিনয় করেন শুনে নাকি খুব অবাকও হয়েছিলেন।
স্বাধীন ভাবে গড়ের মাঠে, গঙ্গাপারে খোলা আকাশের নীচে বসতে পারতেন না উত্তমকুমার। ইচ্ছে হলেই রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে ফুচকা খাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের খেলা দেখতে যেতে পারতেন না। এমন বন্দিদশায় যখন হাঁপিয়ে উঠতেন, তখনই এক সাংবাদিক বন্ধুকে ডেকে নিতেন। সেই সাংবাদিক তাঁর বইয়ে লিখেছেন, খিদিরপুরে পোর্ট কমিশনার্সের দোতলায় একটি জানলার দিকে দেখিয়ে মহানায়ক তাঁকে বলেছিলেন, “ওই জানলাটার পাশে বসে আমি কাজ করতাম। তখন ভাল লাগত না। কিন্তু এখন আবার সেই জীবনটাতে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে।”
উত্তমকুমারের জীবনে কোনও কিছুই খুব সহজে আসেনি। সব কিছুই তাঁকে লড়ে আদায় করে নিতে হয়েছে। ‘ফ্লপমাস্টার জেনারেল’ থেকে ‘মহানায়ক’-এ উত্তরণ— দিনের পর দিন অপমান সহ্য করার পর ‘ইন্ডাস্ট্রি’ হয়ে উঠেছিলেন। তার পরেও শেষের দিকে আবার ছবির বাণিজ্যে ভরাডুবি, মাথায় দেনার দায়। মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত অভিনেতা ঠিক করেছিলেন, ছবি না চললে যাত্রা করবেন! তাতেও উপার্জন হবে। তিনি নাকি কয়েকটি যাত্রা সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগও করেন। উত্তমকুমার যাত্রা করবেন, খবর ছড়াতেই অনুরাগীরা আহত। ইন্ডাস্ট্রির অন্দরে সমালোচনার ঝড়। মৃত্যু এসে যেন তাঁর মুখরক্ষা করেছে।
পার্থিব শরীরের সৎকার ৪৪ বছর আগেই হয়ে গিয়েছে। উত্তমকুমার তার পরেও বর্তমান। সমাজমাধ্যম বলছে, জুলাই মাস অলিখিত ভাবে তাঁর। ২৪ জুলাই তাঁর স্মৃতিতে নতুন করে তাঁকে মনে করার দিন। যেমন, অভিনেতা ফাল্গুনী চট্টোপাধ্যায় করেছেন। তাঁর সামাজিক পাতা বলছে, আজ তাঁর ‘কালাদিবস’! কালো শোকের রং। সেই রং ছড়িয়ে তিনি লিখেছেন, “যাওয়া তো নয় যাওয়া…….পারলে যেতে? ৪৪ বছর হয়ে গেল। থেকেই যখন গেলে, কেন চলে যাওয়া? ”